আমাদের যত টিয়া

টিয়া একটি সুন্দর পাখি যা মানব বসতির কাছে বড় বড় গাছে বাসা বেঁধে থাকে। অনেকেই টিয়া পাখি পুষে থাকেন। সবুজ রঙা টিয়া বাংলাদেশে প্রচুর পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীর উষ্ণ ও নিরক্ষীয় অঞ্চলে এই পাখিটি চোখে পড়ে।

আমাদের যত টিয়া

লিখেছেন: আ ন ম আমিনুর রহমান

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। এর গভীরে উঁচু এক জায়গায় এক জোড়া মান্দারগাছের পাশে তৈরি করা হয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। বসন্তে সেই মান্দারগাছ ফুলে ফুলে টকটকে লাল হয়ে যায়। তাতে বসে নানা প্রজাতির পাখির মেলা।

গত মৌসুমের এক আলো–আঁধারি ভোরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছি ভোরের প্রথম পাখিটির জন্য। ঠিক ৫টা ৩১ মিনিটে ছোট্ট একটা সবুজ পাখি এসে মান্দারের লাল ফুলে ধারালো বাঁকা লাল ঠোঁটটি চালাল। ক্যামেরার শাটার ক্লিক করে উঠল। আরও দুই প্রজাতির সবুজ-লাল পাখি এসেও বসল।

এই তিন প্রজাতির পাখিগুলো শুক বা তোতা বর্গের। দুনিয়াজুড়ে তোতা, টিয়া, আমাজন, কাকাতুয়া, লরিকিট, লরি, ম্যাকাও ইত্যাদির সমন্বয়ে গড়া এই শুক বর্গ। এই পাখিগুলোর নিচের ঠোঁট ছোট, ওপরেরটা বড়শির মতো নিচের দিকে বাঁকানো। হীরার মতো ধারালো ঠোঁট দিয়ে এরা প্রাণীর চামড়া ফুটো করে দিতে পারে অনায়াসেই।

মান্দারের ডালে পুরুষ কইরিদি টিয়া

এদের পায়ের নখও মারাত্মক ধারালো। চারটি আঙুলের দুটি সামনে ও দুটি পেছনে থাকায় অন্য পাখির মতো সহজে এরা সামনের দিকে হাঁটতে পারে না। হাঁটে পাশের দিকে নেচে নেচে। এই তিন গোত্রে সারা বিশ্বে ৪১৪ প্রজাতির তোতা-টিয়ার মধ্যে এ দেশে আছে শুধু সিটাসিডি গোত্রের সাতটি প্রজাতি। সবাই আবাসিক টিয়া।

সাতছড়ির মান্দারগাছে প্রথম পাখিটি ছিল লটকন টিয়া, ঝুলন টিয়া, শুকশারি বা ভোরা। ইংরেজি নাম ভারনাল হ্যাঙ্গিং প্যারট বা ইন্ডিয়ান লরিকিট। এ দেশের সবচেয়ে ছোট ও দুর্লভ টিয়াটির বাস মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও গাছপালাপূর্ণ এলাকায়। খাটো লেজের গাট্টাগোট্টা পাখিটির দৈর্ঘ্য ১৩ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার, ওজন ৩৭ থেকে ৩৮ গ্রাম। বাংলাদেশ ছাড়াও পুরো এশিয়ায় এদের দেখা মেলে।

এর পরের পাখিটি কইরিদি টিয়া, ফুলটুসি, ফরিয়াদি বা টুই (ব্লসম-হেডেড প্যারাকিট)। বিরল ও প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত পাখিটির দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৬ সেন্টিমিটার, ওজন ৮০ থেকে ৮৫ গ্রাম। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং খুলনার সুন্দরবনের আবাসিক পাখিটি পুরো এশিয়ায় ছড়িয়ে আছে।

সবশেষে দেখা পাখিটি মদনা বা লালবুক টিয়া (রেড-ব্রেস্টেড প্যারাকিট)। সচরাচর দৃশ্যমান এই পাখি বাংলাদেশ ছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। মিশ্র পাতাঝরা ও চিরসবুজ বন, চা-বাগান এবং পাহাড়ের পাশের আবাদি জমির পাখিটি লম্বায় ৩৩ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার, ওজনে ১২০ থেকে ১৩০ গ্রাম।

এই প্রজাতি তিনটি বাদেও বাংলাদেশে আরও চার প্রজাতির টিয়ার বাস। তার মধ্যে লালমাথা বা আলুবোখারা মাথার টিয়ার নাম হীরামন টিয়া (প্লাম-হেডেড প্যারাকিট)। দুর্লভ এই পাখির বাস ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বনের প্রান্তের কৃষিজমি, ফলের বাগান ও খোলা বনে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের আবাসিক পাখিটির দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার, ওজন ৫৬ থেকে ৮৫ গ্রাম।

এ দেশের সবচেয়ে বড় টিয়ার নাম চন্দনা টিয়া, বড় টিয়া বা চন্দনা (অ্যালেক্সান্ড্রিন প্যারাকিট)। দুর্লভ পাখিটির দৈর্ঘ্য ৫৬ থেকে ৬২ সেন্টিমিটার, ওজন ২২০ থেকে ৩০০ গ্রাম। ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ঘন প্রাকৃতিক বনবাগানের পাখিটি বাংলাদেশ ছাড়াও উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বাস করে।

টিয়াদের মধ্যে এ দেশের সবচেয়ে বিরল ও শঙ্কাগ্রস্ত ধূসর-মাথা বা কালোমাথা টিয়ার (গ্রে-হেডেড প্যারাকিট) দৈর্ঘ্য ৩৬ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার, ওজন ১১৫ থেকে ১২০ গ্রাম। চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ পাহাড়ি বনের পাখিটিকে বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, ভারত, চীন, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়।

এই গোত্রের সবচেয়ে পরিচিত ও সহজলভ্য হলো টিয়া, ছোট টিয়া, গোলাপিকণ্ঠী টিয়া, সবুজ টিয়া বা টিয়া–তোতা (রোজ-রিঙ্গড প্যারাকিট)। কচি পাতার মতো সবুজ দেহের পাখিটির দৈর্ঘ্য ৩৮ থেকে ৪২ সেন্টিমিটার, ওজন ৯৫ থেকে ১৪০ গ্রাম। ওদের শরীরের এই রঙের জন্যই টিয়া রং কথাটির প্রচলন হয়েছে। সেন্ট মার্টিন বাদে দেশের সর্বত্র বিস্তৃত পাখিটিকে আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ–পূর্ব চীন ও মিয়ানমারে দেখা যায়।

এই সাত প্রজাতির টিয়ারই স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় কিছু পার্থক্য থাকে। সবাই গাছের খোঁড়লে তিন থেকে ছয়টি করে সাদা রঙের ডিম পাড়ে। আয়ুষ্কাল সাত–আট বছর। পোষা পাখির ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে এ দেশের সব প্রজাতির টিয়াই হুমকির মুখে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণী প্রজননবিশেষজ্ঞ

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow